সুশাসন প্রতিষ্ঠায় “নগর আদালত আইন” প্রণয়ন করা জরুরি

আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা, হয়রানি ও অর্থ ব্যয়ের কারণে মানুষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরোধ স্থানীয় পর্যায়ে সমাধানে বেশী আগ্রহী। ইউনিয়ন পর্যায়ে জনগনের সুবিধার্তে এ ধরনের বিরোধ মীমাংসার জন্য রয়েছে গ্রাম আদালত। পৌরসভা পর্যায়ে রয়েছে বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন ২০০৪। ফলে ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ের জনগন তাদের মধ্যে সংঘটিত ক্ষুদ্র বিরোধ আদালতে না গিয়ে স্থানীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভার মাধমে মীমাংসার সুযোগ নিয়ে হয়রানী ও অর্থ বাঁচাতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু দেশের ১২ টি সিটি কর্পোরেশনে বসবাসরত প্রায় ২ কোটি মানুষের জন্য এ ধরনের কোনো আইন নেই। ফলে ক্ষুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তাদের আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। তাই সিটি কর্পোরেশনে বসবাসরত নাগরিকদের জন্য ‘নগর আদালত আইন’ প্রণয়নের লক্ষ্যে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ; মাদারীপুর লিগ্যাল এইড এসোসিয়েশন (এমএলএএ); বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এবং নাগরিক উদ্যোগ। ‘নগর আদালত আইন: প্রস্তাবিত রূপরেখা এবং বাস্তবায়নের সম্ভাবনা’ শীর্ষক এই ভার্চুয়াল সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয় সোমবার ২৮ জুন ২০২১ তারিখে।

সংলাপের মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এডভোকেট খান মোঃ শহীদ, প্রধান সমন্বয়কারী, এমএলএএ। দ্রুত নগরায়নের ফলে জনবসতির ঘনত্ব বেশী হওয়ায় নগরবাসীদের মধ্যে অপরাধ ও বিরোধ সংগঠনের প্রবনতা বেশী। নগরবাসীদের মধ্যে সংঘটিত সালিশযোগ্য/ আপোষযোগ্য বিরোধ স্থানীয় পর্যায়ে মীমাংসার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভার মত কোন আইনী কাঠামো সিটি কর্পোরেশনে নেই। ফলে বিরোধ নিস্পত্তির জন্য নগরবাসীকে থানায় পুলিশের এবং প্রয়োজনে আদালতের কাছে যেতে হয়। আনুষ্ঠানিক আদালতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফৌজদারী ও দেওয়ানী বিরোধ (যা স্থানীয়ভাবে আপোষযোগ্য) নিষ্পওির জন্য কমপক্ষে ২ বছর-এর অধিক সময় অপেক্ষা করতে হয়। আবার এই ধরনের ছোট-খাটো বিরোধ বা মামলা থেকেই জন্ম নেয় বৃহত্তর বিরোধ, ফলে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি প্রতিপক্ষকে হয়রানির জন্য একাধিক মিথ্যা মামলা দায়ের করার অভিযোগও আছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২৭ লক্ষ ২১ হাজার ৮৮৪। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক তথ্যমতে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৯ লক্ষ ৩৩ হাজার ১৮৬টি।

সিটি কর্পোরেশনে বসবাসরত মানুষের দৈনন্দিন আপোষ্যযোগ্য বিরোধ মিমাংসার জন্য অনানুষ্ঠানিক আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় এবং সিটি কর্পোরেরশন/ ওয়ার্ড কাউন্সিলর-এর বিরোধ নিস্পওির জন্য কোন আইনী কাঠামো না থাকায়, জনসাধারণের আর্থিক ক্ষতি, হয়রানি, পারিবারিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুনিদিষ্ট সুপারিশ হলো: নগরে বসবাসরত জনসাধারনের আপোষযোগ্য বিরোধ মিমাংসার জন্য সিটি কর্পোরেশনের আওতায় একটি আইনী কাঠামো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হোক।প্রস্তাবিত নগর আদালত এর কাঠামো চুড়ান্তকরণে ইতমধ্যে প্রাপ্ত সুপারিশসমূহ পর্যালোচনা করে আইনটি প্রনয়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হউক।

জনাব তাজুল ইসলাম, এমপি, মাননীয় মন্ত্রী, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি নগর আদালতের ব্যাপারে নিতিগতভাবে একমত পোষণ করে বলেন, গ্রাম আদালতসহ প্রস্তাবিত নগর আদালতের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে পারলে এই উদ্যোগ সফল করা সম্ভব হবে।

অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি জনাব মোঃ আতিকুল ইসলাম, মাননীয় মেয়র, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন প্রস্তাবিত নগর আদালতে নারী ওয়ার্ড কমিশনারকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন এবং এই আদালতের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এই আদালত গঠনের জন্য তার সমর্থন জানান।

ড. ফস্টিনা পেরেইরা, সিনিয়র ফেলো, সেন্টার ফর পিচ এন্ড জাস্টিস, ব্র্যাক ইউনিভিাসিটি নগর আদালত গঠন করার বিষয়ে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনা করার কথা বলেন। তিনি বলেন এই আদালতের দণ্ডের ক্ষেত্রে আধুনিকতা আনা প্রয়োজন।

ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আইনজীবী, সুপ্রীম কোর্ট ও সম্মানিত নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) বলেন, বাস্তব অবস্থায় নারী পুরুষ নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষ বিচার ব্যবস্থা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না – খরচ , দূরত্ব ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে। সেজন্য কাঠামোগত পরিবর্তন করে বিচারব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। নগর আদালতের প্যানেলে নারীদের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের প্রতি তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, প্রস্তাবিত আইনের সাথে পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির বিদ্যমান পদ্ধতির আন্তসম্পর্কীয় বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

এডভোকেট ফজলুল হক, সম্পাদক, মাদারীপুর লিগ্যাল এইড এসোসিয়েশন (এমএলএএ) এবং জনাব জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ সংলাপে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ সংলাপে সভাপতি হিসেবে বলেন, সুবিচার পাওয়া আমাদের মৌলিক অধিকার। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নগর আদালত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নগর আদালতকে শক্তিশালী করতে হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকেও শক্তিশালী করতে হবে। নগর আদালতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তারপরেও নগর আদালতকে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে এই প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত সংস্থার প্রতিনিধি ও ব্যাক্তিবর্গ এবং জনপ্রতিনিধি সহ সরকারি কর্মকর্তা, আইনজীবী, সামাজিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ, এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা এই সংলাপে অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মতামত ও মন্তব্য তুলে ধরেন। এছাড়াও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নেতৃবৃন্দ এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।