খালেদা জিয়ার বিবৃতি: “দেশ-জাতি আজ সর্বগ্রাসী এক গভীর সংকটে নিপতিত”

ঢাকা, ১২ ডিসেম্বর, (এনএসনিউজওয়্যার) –সংবাদ মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশের জন্য বিএনপি চেয়ারপার্সন, ১৮ দলীয় জোট প্রধান, বিরোধী দলের নেতা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিবৃতি:

“দেশ-জাতি আজ সর্বগ্রাসী এক গভীর সংকটে নিপতিত। সকল বিরোধী রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠন, সংবাদ মাধ্যম, সিভিল সমাজ, সচেতন ও গণতন্ত্রপ্রিয় দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে এমন আশংকাই ব্যক্ত করে আসছিল। আমরা সকলেই এই সংকটের একটা শান্তিপূর্ণ ফয়সালার জন্য বারবার আহবান জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু সরকার বরাবর সেই আহবানকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ভাষায় তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিয়েছে। তারা আলোচনা ও যুক্তির পথ বেছে নিতে রাজী হয়নি। শান্তি ও সমঝোতাকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেনি। বরংতারা কথা বলেছে অস্ত্রের ভাষায়। তারা রাষ্ট্রীয় ও পেশী শক্তির মাধ্যমেই সকল ভিন্নমত দমিয়ে দিতে ও প্রাধান্য বিস্তার করতে চেয়েছে।
“দেশবাসী জানেন, বিরোধী দল হিসেবে আমরা ধৈর্য, সংযম ও সহিষ্ণুতা বজায় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আমাদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য আমরা যা কিছু সম্ভব তার সবই করেছি এবং সকল ফোরামেই গিয়েছি। দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আমাদের বক্তব্য ও দাবির প্রতি সমর্থন, একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় সরকার জনমতকে গ্রাহ্য করেনি। তারা আমাদের শান্তির আহবানকে দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করেছে। তারা রাজপথে আমাদেরকে সংঘাতের প্রতিযোগিতায় আহবান জানিয়েছে এবং নির্মূলের হুমকি দিয়েছে।

“বিরোধী দলের পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা, ঔদার্য, সহনশীলতা, সংযম, সমঝোতা ও ঐক্যমতের ভিত্তিতে বিরাজমান সংকট নিরসনের আহবান জানাবার পরেও সরকার তার জবাব দিয়েছে দমন-পীড়ন ও বলপ্রয়োগের নিষ্ঠুর পথে। ক্ষমতাসীনদের এই অনড় মনোভাব, এই ফ্যাসিবাদী আচরণ, এই নির্মম দমননীতি এবং জনগণের সমর্থনও অনুমোদন ছাড়াই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র আকাক্সখাই আজ দেশকে এক চরম নৈরাজ্যকর ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছে। সরকারের চরম হঠকারিতার কারণেই আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতেও ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে গেছে।

“আমি এ প্রসঙ্গে অভিনন্দন জানাই জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে। তিনি বাংলাদেশের বিরাজমান সংকট নিরসনে দীর্ঘদিন ধরে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। তিনি সর্বশেষে তৃতীয় দফায় তাঁর বিশেষ দূত হিসেবে রাজনীতি বিষয়ে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে পাঠিয়েছেন। আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, গণচীন ও জাপান সরকারসহ বিভিন্ন বন্ধু দেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই, তারাও এ সংকট নিরসনে সমঝোতার আহবান অব্যাহত রেখেছেন। প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশ ভারতের সরকার ও জনগণের প্রতিও আমার আহবান, তারাও যেন বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক জনগণের অনুভূতি, দাবি ও মনোভাবের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অবস্থানের সঙ্গে একাত্ম থাকেন।

“বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্রের নাম-নিশানা মুছে দিয়ে চরম স্বৈরাচারী এক ফ্যাসিবাদী দু:শাসন জগদ্দল পাথরের মতো জাতির ওপর চেপে বসেছে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে। এর ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আজ উত্থাপিত হচ্ছে গুরুতর প্রশ্ন। সংবাদ মাধ্যম আজ শৃক্সখলিত। সংবাদ, টকশো, মতামত নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বেআইনীভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারী সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল। চলছে সরকারের পক্ষে প্রায় একতরফা প্রচারণা। বিরোধী দল ও জনগণের শান্তিপূর্ণভাবে মতামত প্রকাশের এবং প্রতিবাদ জানাবার সকল সুযোগ ও পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিএনপি সহ প্রায় সকল বিরোধী দলের সদর দফতর এবং কার্যালয়গুলো আইন শৃক্সখলা বাহিনী দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মিথ্যা অভিযোগে বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের আটক করে রাখা হয়েছে। সারাদেশে নেতা-কর্মীদের ওপর চলছে হত্যা, গুম, নির্যাতন ও দমন-পীড়ন। সরকার নিজেই সারাদেশে এক চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

“প্রশাসন ও আইন শৃক্সখলা বাহিনীকে আজ দলীয় ক্যাডারের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। জনজীবনের শান্তি ও স্বস্তি নিশ্চিত করার বদলে বিরোধী দল ও জনগণের প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও আন্দোলন দমনেই তাদেরকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রাখা হয়েছে।

“দেশের শিল্প-বানিজ্য-অর্থনীতি আজ স্থবির। সুপরিকল্পিত চক্রান্ত ও নাশকতায় বিকাশমান তৈরী পোশাক খাত আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। সরকারের একগুঁয়েমি এবং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র বাসনার কারণেই আজ সর্বক্ষেত্রে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

“বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করা হলেও সরকারী দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা আইন শৃক্সখলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় রাজপথে প্রকাশ্যে মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে। কাজেই দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ, পৈশাচিক হত্যা, নাশকতা ও অন্তর্ঘাতের যেসব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে, তার দায় পুরোপুরি সরকারকেই নিতে হবে। আমরা বারবার বলেছি,
আজ আবারো বলছি, আমাদের আন্দোলন ও কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক। নিরপরাধ কোনো সাধারণ নাগরিক কোনক্রমেই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের প্রতিটি নেতা-কর্মীকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। জনগণই আমাদের শক্তির উৎস। তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে হবে।
“বাংলাদেশের মানুষ কত বিপুলভাবে আমাদের সমর্থনে রয়েছেন, তা আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে বারবার প্রমানিত হয়েছে। এখনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিলে ও নিষ্ঠুর নির্যাতন বন্ধ করলে মানুষের যে ঢল রাজপথে নামবে তা সৃষ্টি করবে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। সরকার তা জানে এবং তারা একথাও জানে যে, সকল দলের অংশগ্রহণে একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে দেশবাসী তাদেরকে কিভাবে প্রত্যাখান করবে। সে কারণেই তারা সমঝোতার পথ এড়িয়ে সংঘাত ও বলপ্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে। সকল দলকে বাইরে রেখে একতরফা ও প্রতিদ্বন্দিতাহীন এক নির্বাচনী প্রহসনের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে তারা। মহাজোটের শরীক এরশাদের জাতীয় পার্টিও এই তথাকথিত নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দিতা থেকে ইতোমধ্যেই সরে দাঁড়ানোর ফলে পুরো প্রক্রিয়াটিই আজ এক হাস্যকর প্রহসনে পরিণত হয়েছে।

“নির্বাচন মানেই হ্েচ্ছ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা। যে নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দিতা নেই, সেটা কোনো নির্বাচন নয়। অথচ সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর দোহাই দিয়ে সরকার সেই প্রহসনের মাধ্যমেই তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। আর এর প্রতিবাদে সারাদেশে মানুষ আন্দোলন করছে। তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে গুলী করে মারা হচ্ছে। প্রতিদিন ক্ষমতার লোভে রঞ্জিত হচ্ছে সরকারের হাত। সরকারের পৈশাচিক দমন-পীড়ন এবং এর বিরুদ্ধে জনগণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে জনজীবন আজ স্থবির হয়ে পড়েছে। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। অচলাবস্থার কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ সরকার নির্বিকার ও অনড়। দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সকলে অনুভব করলেও সরকার বলছে, সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। এটা কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মনোভাব হতে পারেনা।

“আমাদের আহবান ও দেশবাসীর আকুতিতে সাড়া না দিলেও জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের মধ্যস্থতায় সরকারী দল আলোচনায় বসতে সম্মত হওয়ায় দেশবাসীর মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। আমি আশা করি, বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাকে তারা বিবেচনায় নেবেন এবং একগুঁয়েমি প্রত্যাহার করে শান্তি ও সমঝোতার পথে এগুবেন।

“সমঝোতার পথ প্রশস্ত করার জন্য সংলাপের পরিবেশ তৈরি করা খুবই অপরিহার্য। কিন্তু দু:খের বিষয়, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের এখনো মুক্তি দেয়া হয়নি, প্রত্যাহার করা হয়নি মিথ্যা মামলা। আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন এখনো প্রহসনের নির্বাচনের তফশীল স্থগিত করেনি। বিরোধী দলের অবরুদ্ধ অফিস ও বন্ধ সংবাদ-মাধ্যমগুলো এখনো খুলে দেয়া হয়নি। এখনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। এখনো আন্দোলনকারীদের প্রাণসংহার ও রক্ত ঝরানো বন্ধ হয়নি। এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করে সংলাপ ও সমঝোতার পথ প্রশস্ত করার জন্য আমি সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
“দেশবাসীকে আমি বলবো, জনগণের দাবিকে পাশ কাটাতে সরকার উস্কানি, অন্তর্ঘাত, নাশকতা ও অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপর হামলা, আলেম সমাজের ওপর নিপীড়ন এবং নিরপরাধ মানুষকে অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে হত্যা করে পরিস্থিতির মোড় ঘুরাবার অপচেষ্টা তারা বারবার করছে। এ ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। হঠকারিতার আশ্রয় নিয়ে উস্কানিমূলক বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের উদ্দেশ্য নিয়েও তারা অপপ্রচার করছে। অতীতেও এভাবে গণআন্দোলনকে বিপথগামী করার অপচেষ্টা সফল হয়নি। বর্তমান সরকারও সফল হতে পারবেনা ইনশাল্লাহ।

“আজ লক্ষীপুরে যাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা ইতোমধ্যে আত্মাহুতি দিয়েছেন আমি সেই সকল শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। তাদের স্বজনদের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাচ্ছি। আহত ও নির্যাতিত হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের প্রতি জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সহমর্মিতা। অন্তর্ঘাতে যেসব নিরপরাধ নাগরিক প্রাণ দিয়েছেন, অসহ্য যন্ত্রণা সয়ে এখনো যারা চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের জন্য আবারো গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।

“সংকট থেকে দেশ-জাতির মুক্তির জন্য, গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের সুরক্ষা এবং শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা আন্দোলন করছি। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ও জনগণের পছন্দসই একটি সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ সংগ্রাম তার কাক্সিখত লক্ষ্যে পৌঁছাবে। আমি শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন সকল দেশবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণ কামনা করি।”